ভূমিকা:
মানব সভ্যতার কাছে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই সেই সুদূর অতীতকাল থেকে মানুষ আধুনিক যুগে আধুনিক সভ্যতার রূপায়নে সমর্থ হয়েছে। বিজ্ঞান হল বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল বিষয়। তাই প্রগতিশীলতার অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী বিজ্ঞান নিয়ত পরিবর্তনশীল।সেজন্য বর্তমানে প্রতি মুহূর্তে বদলে চলেছে বিজ্ঞানের চরিত্র, আর এই পরিবর্তিত চরিত্র দ্বারা বিজ্ঞান প্রতিমুহূর্তে আদপে সভ্যতার কল্যাণের উদ্দেশ্যেই সেবা প্রদান করে চলেছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারকে মানুষ ধ্বংসকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে থাকলেও তা বিজ্ঞানের প্রকৃত রূপ নয়।
মানবতার নিয়ম অনুযায়ী বিজ্ঞানের সার্থকতা হল মানব কল্যাণে। মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিককে বিভিন্নভাবে সেই প্রাগৈতিহাসিক অতীত থেকে উন্নত করে তুলে বর্তমান আধুনিক যুগে পৌঁছে দেওয়ার মূল কারিগর হলো বিজ্ঞান।
ইতিহাসে মানবকল্যাণ ও বিজ্ঞান:
ইতিহাসে মানুষের আগমনের মুহূর্ত থেকে মানব কল্যাণ ও বিজ্ঞান চলেছে হাত ধরাধরি করে। মানুষ নিজের কল্যাণের জন্য যতটুকু কীর্তি সাধন করেছে, তার প্রায় সবটুকুই সে অর্জন করেছে বিজ্ঞানের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা দরকার বিজ্ঞান কোন আকস্মিক অপার্থিব পরাশক্তি নয়, বরং বিজ্ঞান হল মানুষের মনের অন্তঃস্থলে স্থিত বুদ্ধি দ্বারা প্রকৃতি ও পরিবেশকে নির্দিষ্ট উপায়ে ব্যবহার করার নিমিত্ত বিশেষ জ্ঞান।
এই জ্ঞানকে সহায় করেই মানুষ পাথরে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাতে শিখেছে, অস্ত্র তৈরি করে নিজের আত্মরক্ষা ও খাদ্য আহরণ করতে শিখেছে, চাকা আবিষ্কার করে সভ্যতার গতিপথকে দিয়েছে অভাবনীয় দ্রুততা এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিজ্ঞানের এই সকল আদি দানগুলি সময়ের সাথে সাথে উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে; এবং এই উন্নতির সাথে সাথে কাঙ্খিত মানবকল্যাণ হয়ে উঠেছে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সমার্থক।
অনন্ত সম্ভাবনাময় আধুনিক বিজ্ঞান:
বিজ্ঞান সৃষ্টির আদিমতম লগ্ন থেকেই পরম সম্ভাবনাময়।বিজ্ঞানের সেই পরম সম্ভাবনা পূর্ণরূপে বিকশিত হয়েছে আধুনিক যুগে। উপমহাদেশের ইতিহাসে ব্যাপক বিজ্ঞান চর্চার নিদর্শনকে স্বীকার করে নিয়েও একথা বলতেই হয় যে আধুনিক যুগে যেভাবে বিজ্ঞানকে জীবনমুখী কাজে প্রয়োগ করা গেছে তা ইতিপূর্বে কখনো সম্ভব হয়নি।
আধুনিক যুগে শিল্প বিপ্লবের প্রাকমুহুর্ত থেকে সমগ্র বিশ্বে বিশেষত পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে যে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জোয়ার আসে, তা সমকালীন পৃথিবীতে মানুষের জীবনচর্যার চরিত্রকেই বদলে দিয়েছিল। এই বদলের সঙ্গেই এসেছিল যুগান্তকারী শিল্প বিপ্লব, যা পরবর্তী সময়ে মানবকল্যাণে ব্যাপক জোয়ার নিয়ে আসে।
বিজ্ঞানের এই জোয়ারের সাথে সাথে শিল্প বিপ্লবের চাকায় ভর করে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটতে থাকে নানা মানবকল্যাণকারী বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন যুগান্তকারী প্রতিভার হাত ধরে সেই সকল সম্ভাবনার বাস্তবায়ন ধীরে ধীরে সম্ভব হয়ে উঠেছে।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের ভূমিকা:
সকালে আমাদের ঘুম ভাঙ্গানোর অ্যালার্ম, বিছানা ছেড়ে টুথ পেস্ট,গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না , অফিস যাওয়ার গাড়ী, কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর, মোবাইল, টেলিভিশন, বাস, ট্রেন, এরোপ্লেন সবকিছুর সাথেই জড়িয়ে রয়েছে বিজ্ঞান। আমাদের জীবনকে সহজ থেকে আরো সহজতর এবং দ্রুত থেকে আরো দ্রুততর করে তোলার পথে বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। বিজ্ঞানহীন হয়ে মানব সভ্যতার অগ্রগতি এমনকি অস্তিত্ব রক্ষা; কোনটাই সম্ভব নয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে সহজ সরল আরামদায়ক করে তুলেছে। অসহ্য গরমে তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, মানুষের সুবিদার্থে বিজ্ঞানীরা ঘুরিয়ে দিয়েছেন নদীর গতিপথ, উষ্ণ মরুকে তা করেছে শস্য শ্যামল। হাড় ভাঙা পরিশ্রমকে বিজ্ঞান অনেক সহজ করে দিয়েছে। আজকের কর্মব্যস্ত মানুষ বিজ্ঞান ছাড়া একপাও এগোতে পারে না ।
বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি:
মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের প্রভাব সম্পর্কিত আলোচনায় তথ্যপ্রযুক্তির উল্লেখ থাকবে না, এমনটা হতেই পারে না। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের সম্ভবত সবচেয়ে যুগান্তকারী দানটি হল তথ্যপ্রযুক্তি। তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের প্রতিদিনকার জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছে। মানুষের সামাজিক, পারিবারিক তথা প্রশাসনিক জীবন সহ সর্বক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।আর এই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে বিজ্ঞানের দুই উল্লেখযোগ্য ফসল: কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা। জীবনধারণে অভ্যাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তথা মননের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাছাড়া এই তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থা লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান:
শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বিজ্ঞান শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে তথ্য প্রযুক্তির বিশ্বে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ আর প্রাথমিক অবস্থায় সীমাবদ্ধ নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে বিজ্ঞান প্রথাগত শিক্ষার বাইরে বেরিয়ে দূরবর্তী শিক্ষা বা অনলাইন এডুকেশন দ্বারা শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রান্তিক অঞ্চলেও।
তাছাড়া বিজ্ঞানের সহায়তাতেই নানা প্রকার আধুনিক গবেষণা বাস্তব রূপ পাচ্ছে। সেই সকল গবেষণা প্রতিনিয়ত মানবকল্যাণে উপযোগী হয়ে উঠছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের এহেন উপযোগিতা থেকে বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণের দূত বলা ছাড়া উপায়ান্তর থাকেনা।
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভূমিকা:
সভ্যতার সেই শুরুর দিন থেকেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান তার অবদান রেখে চলেছে। আর আজ প্রযুক্তি বিজ্ঞানের দানে চিকিৎসা ব্যবস্থায় চূড়ান্ত উন্নতি সাধিত হয়েছে। স্বভাবতই মানুষের গড় আয়ু আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগের প্রতিকারের জন্য মানুষ আজ ওঝার কাছে না দৌড়িয়ে হাসপাতালমুখী হয়েছে।
প্রতিনিয়ত গভীর গবেষণালব্ধ বিভিন্ন জীবনদায়ী ওষুধ মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে কৃত্রিম অক্সিজেন, ভেন্টিলেটরের মতো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আপৎকালীন মুহূর্তে মানুষের জীবন বাঁচিয়ে চলেছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলস্বরুপ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভ্যাকসিন নানাবিধ রোগকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে সাহায্য করেছে। সর্বোপরি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যাপক ব্যবহার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অনেক বেশি সহজ এবং যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উপসংহার:
মানব সমাজের সার্বিক কল্যাণকারী সম্ভাবনা মূলক অসংখ্য দিক থাকলেও এই বিজ্ঞানী আবার ব্যবহৃত হচ্ছে মানব সভ্যতার ধ্বংসযজ্ঞকারী শক্তি সৃষ্টিতে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে এমন সব বিষ এবং মারণাস্ত্র সমগ্র মানবজাতিকে মুহূর্তের মধ্যে চূড়ান্ত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। পৃথিবীর কোন মানব কল্যাণকারী শক্তির এহেন ভূমিকা শোভা পায় না। কিন্তু পাশাপাশি আবার এটাও সত্য যে যেকোনো ভালো দিকেরই একটি অন্ধকারময় দিক থাকে।
মনুষ্যত্বের কর্তব্য হলো সেই সকল অন্ধকার দিক গুলি থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে শুধুমাত্র কল্যাণকারী দিকগুলিকে সভ্যতার উন্নতির প্রয়োজনে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো। একমাত্র তাহলে মানুষের আত্মার অন্তস্থিত এই বিশেষ জ্ঞানের দোত্যনা সার্থকতা লাভ করতে পারবে। সমগ্র মানবজাতি মিলে আবার স্বপ্ন দেখবে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ নিয়ে এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার।